প্রিয় পৌলমী
দি…
সে অনেককাল আগের কথা -তখন ইয়াহু আর রেডিফ মেল এর জমানা,
নতুন নতুন ইন্টারনেট এর চলন আর ইয়াহু মেসেঞ্জার এর চ্যাট বাক্স তো রীতিমতো পদী
পিসী ও প্যাণ্ডোরা কে কমপ্লেক্স গুঁতোচ্ছে! ইমেল চেক করতে ক্যাফে তে যাওয়া একটা
রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের মধ্যে ধার্য করতাম। এমনি এক দিনে আমার মেল বাক্সে “উনিশ কুড়ি”-র
রিপ্লাই আবিষ্কার করলাম–অভিনেতা জিত কে নিয়ে সংখ্যা র জন্য পাঠানো অনুরোধের ছোট্টো দু শব্দের প্রত্তুত্তর। প্রিয় ম্যাগাজিনের থেকে “মেঘ না চাইতেই জল পাওয়া”র সেই
মহা মুহূর্ত এক মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামের বালার কাছে ক্লাঊড নাইন বইকি ! পৌলমী দি র সাথে
আলাপের এটাই প্রথম সিন।
ইমেল ইমেল বেশ চলছিল - কখনো বিশেষ সংখ্যার আবদার তো কখনো সমালোচনা...চিঠি
পাঠানো শুরু করলাম –ছাপাও হল! সেকি উল্লাস ! ছাপা অক্ষরে নিজের নাম প্রথমবার দেখা!
হাই স্কুলের “লাল ফিতে সাদা মোজা” তখন স্কুল সেলেব! প্রথম প্রথম পৌলমী দি নিজে ফোন করতেন সদ্য প্রকাশিত সংখ্যা র
ফিডব্যাক নিতে, সহজ ভাবে মন খুলে পূণখ্যাণুপূখ্য মতামত ব্যক্ত করতাম। মনে আছে -- উনিশ কুড়ির রিডার্স মিটে র পরদিন পৌলমী দিকে ফোন করতেই উনি বললেন “তুমি তো সব্বাইকে একেবারে ইমপ্রেস করে দিয়েছ!
আমরা তোমার কথাই বলছিলাম যে কত গুছিয়ে মেয়েটা নিজের বক্তব্য সামনে রাখে ।” ফোনের
ওপারে আমি তখন এম্ব্যারেসড আমার জীবনের অন্যতম সেরা কমপ্লিমেন্ট পেয়ে!
আমার কেরিয়ার এর সূত্রপাত এবং
মিডিয়ায় হাতে খড়ি পৌলমী দির হাত
ধরেই। অনেককিছু শিখিয়েছিলেন তিনি কখনো বলে, কখনো না বলে। আমার লেখা কোনোদিন স্কুলের ম্যাগাজিনেও ছাপা হয়নি তাই “ইছাপুরের অ্যানা
ফ্রাঙ্ক” সীমাবদ্ধ ছিল কেবল তার “কিটি”তেই।
বাবার উৎসাহ আর পৌলমী দির দৌলতেই
একটা সর্ব ভারতীয় ম্যগাজিনে নিজেকে দেখতে পেয়েছিলাম।
উনিশ কুড়ি র পাঠক থেকে লেখিকায় তবদিল হতে বেশি সময় লাগল না। একদিন ফোনে সাহস
করে বলে বসলাম “হ্যাং আউট” নিয়ে লেখা পাঠাব ? দিদি বললেন –পাঠাও।” সেই শুরু –মাসের
৪ ও ১৯ তারিখ তখন জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করিল ! ৬ নম্বর প্রফুল্ল চন্দ্র
স্ট্রিট পরিচিত এলাকায় পরিণত হইয়া উঠিল,কাগজে কলমে হাতে লেখা আর্টিকল কখনো পোষ্ট
করিয়াছি কখনো বা নিজ হাতে জমা দিয়া আসিয়াছি। একদিন দিদিকে শুধাইলাম- লেখা পড়িয়াছেন?
কেমন লাগিল ?
পৌলমী দি-“ভালোই লিখেছ, কিন্তু লেখা গুলো
একটু সাহিত্য ধরনের...
বাংলা মিডিয়াম নড়ে চরে বসল- “মানে ?”
পৌলমী দি- “মানে ম্যাগাজিনের জন্য ভাষাটা
একটু মুচ মুচে করতে জানতে হবে ।”
মুচমুচে বাংলা শিখতে বাংলা মিডিয়ামের বেশি সময় লাগল না অবশ্য। সহজ চলতি ভাষাকে
ভর করে বাংলার বয়ঃসন্ধিদের কাছে পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন পৌলমী দি।
“উনিশ কুড়ি” আমি ও আমাদের অনেকের জীবনেরই একটা টার্নিং পয়েন্ট নিঃসন্দেহে,
কিন্তু আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে যে শুধু পৌলমী দিই আমাদের জীবনের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট ও কেরিয়ারের গোরাপত্তনাধিকারিনী। প্রথম
চেক টা যেদিন পোস্টে হাতে পেলাম সেদিন খুব হতবাক হয়ে প্রফেশনাল গাড়লের মত পৌলমী
দিকে ফোন করলাম—
পৌলমী দি- “বলো...”
আমি- এ...এ...এটা কি একটা চেক এসেছে আমার নাম লেখা আছে, কেন বুঝতে পারছিনা...
পৌলমী দি- (কিঞ্চিৎ বিরক্ত) হ্যাঁ তো ...না
বোঝার কি হয়েছে !
আমি- ও... আচ্ছা ! (ফোন কাট)
কনফার্ম হল আমি একটা চেক নয় একটা অফিশিয়াল পদবীও পেলাম–
“ফ্রিলান্স জারনালিস্ট” এর!
বলা বাহুল্য আমি যে চ্যারিটি করছিলাম সে খবর জানতে আনন্দ বাজার পিছিয়ে পড়েছিল!
এদিকে আমার লোভ বাড়ছিল....
টাকার নয় ...লেখার! “উনিশ কুড়ি”- র বিভিন্ন কলামে নিজের লেখা সাজানোর। তো
একবার উনিশ কুড়ির-গসিপ কলাম লিখিতে গিয়া গসিপ কম পরিয়াছিল- আগেই বলেছি তখন ইন্টার নেটের
এত সিক্স প্যাক ছিলোনা, আমি সোজা
“আনন্দলোক” এর গসিপ কলাম থেকে ঝেড়ে টুকে দিলাম। পৌলমী দির ডাক পড়ল, গেলাম- আমাকে সমানে বসিয়ে দুটো ম্যাগাজিন পাশাপাশি রেখে মুচকি হেসে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে
বললেন –“স্বচ্ছতোয়া, ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড় ধরা’ –নকল করাটাও একটা আর্ট...নকল
আর ইন্সপিরেশনের মধ্যে ফারাকটা বোঝো!” ভুলতে
পারবনা কোনোদিন ।
একটা যা তা ঘটনার কথা না বললেই নয়...
তখন আমি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে- জনৈক এক পরিচালকা মহাশয়ার ইনটারভিউ নিয়েছিলাম।
ছাপার পর যখন ফোন করলাম ওনাকে, উনি ফোনে যাচ্ছেতাই ভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন কিছু ভুল
তথ্য ছাপার কারনে- স্বীকার করতে আপত্তি নেই ভুল টা আমারই ছিল। যাইহোক উনি বিশ্রী
ভাবে রিয়্যক্ট করলেন এবং হুমকি দিলেন আনন্দ বাজারে ফোন করে আমার নামে কমপ্লেন
করবেন। এহেন কেস খওয়া আমার জীবনে প্রথম! ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায় আফটার অল...তাই যাতে
কোন ভুল বোঝাবুঝি না হয় তাই ভাবলাম পৌলমী দি র সাথে দেখা করে ব্যাপারটা জানাবো। এবিপি র অফিসে ড্রপ করতে আমার এক
দাদা আর তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড এসেছিল, হাতে
একটু সময় ছিল তাই এবিপির পাশেই একটা রেস্তরাঁয় আমরা বসলাম। আসন্ন ঝাড়ের ভয়ে
নার্ভাসনেস আর টেনশনে আমার তখন অবস্থা টাইট। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমার কেস জন্ডিস
দেখে আমায় মরাল সাপোর্ট এর পাশাপাশি কারনসুধা অফার করল। বলল- “চুপচাপ খেয়ে নে
দেখবি তোর পৌলমী দির সামনে ফুল
কনফিডেন্ট ফিল করবি, ভয় ডর কেটে যাবে!” সেই প্রথম সুরা পান আমার জীবনে আর সেও এমন
চাপের পরিস্থিতিতে!!! তেতো পানীয় দু পাত্তর পানের পর আমার ঘুম পেতে লাগল...বন্ধুবরেরা প্রমাদ গুনল বলল “হ্যাঁরে তুই
যেতে পারবি ত? আমরা নিচেই অপেক্ষা করছি নাহয়।” হাল্কা হাল্কা সুরুর নিয়ে আমি বসের
দোরগোড়ায় উপস্থিত হলাম নিজের ছড়ানো রায়তা নিয়ে ডিসকাস করতে! যখন বেরলাম মিটিং শেষে
তখন আমার “সুরুর” উড়ে গ্যাছে বলাকা হয়ে! দুই লাল কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে! কেঁদে কেটে
একসা! সলিড ঝাড় এর ফুলপ্রুফ!
আমাকে বকে
ওনারই পরে মন খারাপ হয়েছিল কিনা কে জানে পরবর্তীকালে এই নির্দিষ্ট ইন্টারভিউ সম্পর্কে
উনি বলেছিলেন “সবাই ইন্টারভিউ নেওয়ার যোগ্য হয়না স্বচ্ছতোয়া, তুমি ভাউচ করলে বলে আমি
নিতে দিলাম।”
আরেক মহিলা
সেলিব্রিটির কথা মনে পড়ছে, ইন্টারভিউয়ের জন্য অ্যাপ্রোচ মাত্র উনি আমাকে এক পাঁচ তারা হোটেল এ দেখা করতে বললেন। হোটেল মানেই হস্পিটালিটি!
একে ফ্রিলান্সার তায় কলেজ স্টুডেণ্ট! বিল গোনার আগে প্রমাদ গুনলাম- ভরসা বিগ বস! বললেন –“হ্যাঁ হোটেলে গেলে তোমাকেই বিল দিতে হবে! এক কাজ কর একে
আর ফোন করার দরকার নেই যত্তসব লোভী লোকজন!” যেমন বলা তেমনি কাজ!
উনিশ বছরের
জন্মদিনে এবিপি তে লেখা জমা দিতে গিয়েছিলাম। ফোনে মজা করে বলেছিলাম “উনিশ বছরের জন্মদিনে,
উনিশ কুড়ির জন্য লেখা “উনিশ কুড়ি”তে জমা দিতে আসবো!” অফিসে গিয়ে লেখা জমা দেওয়ার পর
ডেস্ক থেকে বেরিয়ে এল একটা গিফট বক্স আর চকোলেট! আমি ত আত্মহারা! গিফট বক্স থেকে বেরিয়ে
এল একটা কাঠের তিন পাল্লার ফোটোফ্রেম! পৌলমী দি বললেন “এতে তোমার নানা মুহূর্ত সাজিয়ে রেখো আর চকোলেট টা খেয়ো কিন্তু।”
উনি হয়ত ভেবেছিলেন যে আমি ডায়েট কন্সাস টিণেজার! যাইহোক ফ্রেম টা আজও আমার নানা
মুহূর্ত কাঁধে নিয়ে আমার মুম্বাইয়ের বসবার ঘরে বিরাজমান। পৌলমী দির জন্মদিনে আমি একটা জাম্বো কোলাজ কার্ড
বানিয়ে উপহার দিয়েছিলাম। শুধু উনিশ-কুড়ি র নানা বিভাগের নাম আর পৌলমী দির লেখা নানা কবিতার নামের মিশ্রণে একটা
শুভেচ্ছাবার্তা। ভীষণ ইম্প্রেসড হয়েছিলেন। বলেছিলেন- “ আমি ভাবতেই পারিনি তুমি এত
সুন্দর একটা কার্ড বানাবে!”
ভৌগোলীক দূরত্ব বাড়লেও সবসময়ই জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছি। উনিও পাঠিয়েছেন
কখনো কখনো, কিন্তু সেই উনিশ বছরের জন্মদিনের সারপ্রাইজ খুব স্পেশাল ছিল। ২ বছর আগে
ডায়রিতে লেখা সেই কথা আর সেই ফোটো ফ্রেমের ছবি তুলে পৌলমীদিকে ওনার জন্মদিনে
পাঠালাম। লিখলাম –“আজও অমলিন” প্রত্তুত্তর এল- “ কি বলব ... ভীষণ ভালো লাগছে,
তুমিও ভালো থেকো।” সম্প্রতি জেনেছি যে উনি চিকিৎসার জন্য মুম্বাই আসতেন –ঘুণাক্ষরেও
যদি জানতাম উনি কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন...। এমন অদৃষ্ট! কিছুই জানতে
পারিনি।
সবসময়ই নানা ভাবে অ্যাপ্রিশিয়েট করে গ্যাছেন জীবণের নানা ওঠা পড়ায় -প্রথম
ফিল্ম “লুটেরা” রিলিজের আগে জানিয়েছিলেন-“ঊই আর হ্যাপি ফর ইউ, উই আর প্রাউড অফ ইউ।”
কবিতা পাঠিয়েছি –পড়েছেন, বলেছিলেন –দেশ বা সানন্দায় পাঠানোর জন্য। আমি এতেই খুশি
ছিলাম যে পৌলমী দির ভালো
লেগেছে।
শেষ চিঠি ...
“প্রিয় পৌলমী দি”-সবসময় এই
নামেই সমস্ত মেল/ ইমেলে সম্বোধন করেছি ওনাকে, মা-মাসি-দিদিমনি দের বাইরে আমার
জীবনে উনি এমন এক চরিত্র ছিলেন যার কাছে প্রফেশনালিজম, বকা, প্রশ্রয়, সাপোর্ট
পেয়েছি। প্রথমবার "আপনি কি সেই স্বচ্ছতোয়া গুহ যিনি উনিশ কুড়ি তে লেখেন ?” বা
প্রথম অটোগ্রাফ দেওয়া লেখিকা হিসেবে, প্রথম সেলিব্রিটি জগতে প্রবেশ করা- আমার
জীবনের অনেক অসাধারণ এবং প্রথমের কারন হলেন পৌলমী সেনগুপ্ত। যারা আমাদের প্রতি বিশ্বাস করেন ভরসা রাখেন দুনিয়াকে প্রমান
করার আগেই-উনি আমার জীবনে এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, বাবা মা র পাশাপাশি যাঁদেরকে
নিজের জন্য গর্ববোধ করাতে চাইতাম উনি তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। কলেজে থাকতে আমাকে
একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন ভবিষ্যতে কি হতে চাই আমি বলেছিলাম–অ্যাক্টর-ডিরেক্টর, রেগে
গিয়েছিলেন। লেখিকা বা সাংবাদিক বললে হয়ত খুশি হতেন সেই মুহূর্তে। আমার উচ্চ
মধ্যমিকের রেজাল্ট জানার জন্য নিজে ফোন করেছিলেম, সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে আমি
কাঁদছিলাম – উনি বলেছিলেন “কান্নার কিচ্ছু হয়নি স্বচ্ছতোয়া, জীবনটা অনেক বড়।”
আমি যে ওনার চোখে “সম্ভাবনাপূর্ণ” তা জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে ওনার সস্নেহ
সহযোগিতায় টের পেয়েছি। আনন্দবাজার থেকে বরাবরই অনেক এক্সপোজার পেয়েছি পাঠিকা, লেখিকা,
অভিনেত্রী হিসেবে-আর তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
এক অদ্ভুত স্রদ্ধাসমীহজুক্ত ভালোবাসা ছিল ওনার প্রতি, প্রনাম করতে গেলে প্রনাম
করতে দিতেন না। সময়ের সাথে সাথে হায়ারারকি ও তরল হয় তাই বহুদিনের ইচ্ছে ছিল একটা
হালকা আড্ডা আর একসাথে একটা ছবি তোলার- আর হল না, হবেও না।
কত স্মৃতি আজ হাতড়াচ্ছি, খুব কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যু সংবাদ শুনে অবশ হয়ে গিয়েছিলাম-কাঁদিনি-আজ
আর পারছিনা। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে স্বরণ বা স্রদ্ধাজলি জীবদ্দশাতেই হওয়া
উচিত। আমার জীবনের প্রথম বস, প্রিয় দিদি- সবসময় দূর থেকেই সমীহ করেছি, কৃতজ্ঞ
থেকেছি, আজ সবাই এই লেখাটা পড়বে,জানবে শুধু পৌলমী দি ছাড়া।
----- “গ্রহণ করেছ যত ... ঋণী তত করেছ
আমায়
.......................হে বন্ধু বিদায়.....................।।”
--- স্বচ্ছতা সঞ্জীবন গুহ